[এটা একটা নিতান্তই ব্যক্তিগত বকর বকর ধরনের লেখা। মার্কিন মুলুকে যাত্রা পথের এবং অবস্থানকালীন টুকিটাকি স্মৃতিচারণ। মুখবন্ধেই এটা স্বীকার করে নিচ্ছি যে এই লেখায় বিলেত গমনের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য খুবই কম থাকবে। গুগলের বোকাবটের কল্যাণে যদি ভুলক্রমে এখানে এসে পড়েন, ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।]
[আগের পর্ব]
মেঘের ফাঁক দিয়ে লন্ডন শহরের টুকরো টুকরো ছবি দেখতে দেখতেই বিমানের চাকা মাটি ছুঁয়ে কেঁপে উঠলো। যাত্রার এই শেষ এক ঘণ্টা যেন অনন্তকাল ধরেই চলছিল। মেঘলা মন খারাপ করা আবহাওয়া আর সাথে টিপটিপ বৃষ্টি। এক টার্মিনাল থেকে আরেক টার্মিনালে যাওয়ার শাটলের জন্য লম্বা লাইন। এর মধ্যে সেই ইতালিয়ান দম্পতির পাগলের মত দৌড়ঝাঁপ শুরু। বিমান হিথরো পৌঁছাতে ৩০/৪০ মিনিট দেরি করায় তাদের পরবর্তী ফ্লাইটের গণ্ডগোল হয়ে গেছে। ১০ মিনিটের মধ্যে পরের বিমান ছেড়ে যাবে কিন্তু শাটলের জন্য অপেক্ষা করলে ৩০ মিনিটের কমে পৌঁছানো সম্ভব না। তাদের হৈচৈ-এ কর্তৃপক্ষ বিরক্ত হয়েই সম্ভবত একটা আলাদা গাড়ি জোগাড় করে দিল। অবশ্য ফ্লাইটের ১০ মিনিট বাকি থাকতে ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটে কিভাবে ওঠা সম্ভব তা বোধগম্য হল না।
শাটলটা খারাপ না। একটা বসার জায়গা পেয়ে চট করে বসে পড়লাম। দোহা থেকে শিক্ষা হয়েছে। বেশি ভদ্রতা করতে গিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না। বিমানবন্দরের শাটল বাসের চালকরা ঢাকার সিএনজি চালকদের চেয়েও বেপরোয়া।
শাটল বাসে ফ্রি ওয়াই-ফাই পেয়ে ফোনে সবার সাথে কথা বলতে বলতেই টার্মিনালে পৌঁছে গেলাম। এই টার্মিনালটা সম্ভবত বেশ পুরনো। দেখে অনেকটা ঢাকার ইস্টার্ন প্লাজার কথা মনে হল। এককালে অভিজাত ছিল, এখন পুরনো আভিজাত্য নেই, শুধু স্মৃতিটা আছে।
একটা বাথরুম খুঁজে একটু ফ্রেশ হয়ে কফি হাতে দোকান-পাটের মাঝে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি। সব বিমানবন্দরেই মোটামুটি একই রকম দোকান। কিছু দুর্লভ মূল্যের সুভ্যেনির শপ, কিছু অত্যধিক দামী চকলেট, কিছু ইলেকট্রনিক্স। ফাঁকা একটা জায়গা দেখে বসে পড়লাম। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তিটা আস্তে আস্তে বুঝতে পারছি। অপেক্ষার মধ্যেই আবার সেই ইতালিয়ান দম্পতিকে দেখতে পেলাম। এত কাণ্ড করে আলাদা শাটলে গিয়েও বেচারা ফ্লাইট মিস করেছেন।
এবার শেষ ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা। এটা আবার আমেরিকান এয়ারলাইন্স এর বিমান। তাদের চেকইন কাউন্টারটা টার্মিনালের দূরতম প্রান্তের বর্ধিত অংশে। এই অংশটুকু বেশ নতুন মনে হচ্ছে। ভেন্ডিং মেশিন থেকে একটা কোক নিয়ে চিন্তা করছি ২৫০মি.লি. কোকের দাম পড়লো প্রায় ১০০০ টাকা! এখানে ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষ নেই?
বাইরে দাঁড়ানো বিশাল বিমান ঘিরে ব্যস্ততা দেখতে দেখতে ডাক পড়লো লাইনে দাঁড়ানোর। বিমানের দরজা পেরিয়ে মাথা গলাতেই মনে হল যাত্রার এই দীর্ঘতম অংশটাই সবচেয়ে কষ্টকর হবে। চিৎকার-হৈচৈ শুনে মনে হল গাবতলি থেকে বাসে উঠলাম! আমেরিকান এয়ারলাইনের বিমানগুলো একটু পুরনো। কাতার এয়ারলাইনের আগের দুটা ফ্লাইটই ছিল এয়ারবাস, এবার বোয়িং। সিটের মাঝে জায়গা কম, আরামও কম। এখানে কোনও ফ্রি হেড-ফোন বা কুশনের প্যাক নেই, ওয়াই-ফাই কিনতে হবে বাড়তি টাকা দিয়ে, এন্টারটেইনমেন্ট সিস্টেমে মুভি দেখতে হলেও একই ব্যাপার। দুঃখজনক! কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে ক্লান্তিটা দূর করার যাক, তারপর সময় না কাটলে ওয়াই-ফাই কিনে নেওয়া যাবে – এই ভাবতে ভাবতেই নতুন যন্ত্রণা – সিটের লিভার জ্যাম হয়ে আছে, কিছুতেই পেছানো যাচ্ছে না। পিঠ খাড়া করেই ঘুমাতে হবে।
আমেরিকান এয়ারলাইনের খাবার অবশ্য একদম খারাপ ছিল না। প্রথমে কিছু আলুপোড়া আর ডাল ঘণ্ট টাইপের খাবার খেলাম। পরে আবার বিরিয়ানিও আসলো – আগে থেকেই মিল সিলেকশনের সুফল। আমার বিরিয়ানি দেখে পাশের আইলের প্রতিবেশী যাত্রীর হিংসিত হম্বিতম্বি দেখে কিছুক্ষণ বিনোদন নিলাম। বিনে-পয়সায় এন্টারটেইনমেন্ট সিস্টেম তো চলে না – এসব দেখেই সময় কাটলো। পাশের সিটের দুই ভদ্রলোকের আলোচনা শুনেও সময় গেল বেশ খানিকটা। একজন এক্কেবারে “মাগা” টুপি পরা ট্রাম্প সমর্থক, অন্যজন ইমিগ্র্যান্ট আমেরিকান এবং ডাই-হার্ড ডেমোক্র্যাট।
শেষ পর্যন্ত যখন ল্যান্ড করার জন্য সিটবেল্ট বেঁধে নেওয়ার ঘোষণা এলো ততক্ষণে মাথা প্রায় নষ্ট অবস্থা। আর কিছুক্ষণ এভাবে বসে থাকতে হলে ইমার্জেন্সি দরজা খুলে লাফ দেওয়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল। মেঘের ভেতর থেকে উড়োজাহাজ নিচে নেমে আসতেই নিচে দেখছি শুধু ক্ষেত-খামার, জলাভূমি। একটু দূরে শহরের কিছু কিছু ভবন চোখে পড়তে না পড়তেই রানওয়ে ছুঁলো বিমানের চাকা। বিমান যাত্রা শেষ হল বটে, তবে যন্ত্রণা শেষ হতে এখনও অনেক দেরী। মোবাইলটা চালু করে দেখি পুরো ফ্লাইটের সময়টা চার্জে লাগিয়ে রাখার পরেও ব্যাটারি মাত্র ১০% এ আটকে আছে!
Leave a Reply