[এটা একটা নিতান্তই ব্যক্তিগত বকর বকর ধরনের লেখা। মার্কিন মুলুকে যাত্রা পথের এবং অবস্থানকালীন টুকিটাকি স্মৃতিচারণ। মুখবন্ধেই এটা স্বীকার করে নিচ্ছি যে এই লেখায় বিলেত গমনের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য খুবই কম থাকবে। গুগলের বোকাবটের কল্যাণে যদি ভুলক্রমে এখানে এসে পড়েন, ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।]
[আগের পর্ব]
বিমানে উঠেই পরিচয় হয়েছিল আমার পাশের আসনের সহযাত্রীর সাথে। পড়ালেখার উদ্দেশ্যেই যাচ্ছেন মার্কিন মুলুকে। প্রথম বিমান যাত্রায় কিছুটা ভয় পাচ্ছিলেন। মেনু কার্ড হাতে নিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখি তিনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ভয় কাটানোর জন্যই ইচ্ছে ঘুম কিনা কে জানে! তাকে আর না জাগিয়ে বাদাম চিবুতে চিবুতে সিনেমা পছন্দ শুরু করলাম।
ইতিমধ্যে সামনের আসনের বাচ্চার কান্নাও বন্ধ হয়েছে। বেচারা কিছুতেই সিটবেল্ট বাঁধতে রাজি না। বিভিন্ন রকমের তিন-চার সেট খেলনা দিয়েও তার গগনবিদারী চিৎকার থামানো গেল না। পাশে বসে তার মা শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে বিব্রত মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেন। বুদ্ধিমান ছেলে বলতেই হবে। সব বাচ্চার জন্য একসেট খেলনা থাকলেও সে তার চার সেট খেলনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
কাতার এয়ারের ইন-ফ্লাইট এন্টারটেইনমেন্ট সিস্টেম খারাপ না। প্রায় সব নতুন সিনেমাগুলোই আছে। মাটি থেকে প্রায় ত্রিশ হাজার ফুট উপরে বসে এ্যাভেঞ্জার্স দেখতে দেখতেই চিকেন বিরিয়ানি হাজির হয়ে গেল। সবচেয়ে কমদামী টিকেটের সিটে বসেও ফ্রি ওয়াই-ফাই পেয়ে বেশ অবাক লাগলো। মোটামুটি পাঁচ ঘণ্টা পরেই জানালার পাশে দেখা গেল আলো ঝলমলে দোহা। প্রায় চার ঘণ্টার যাত্রা বিরতি এখানে। শুরুতে এক ঘণ্টার দেরীর কারণে অপেক্ষার সময় একটু কমলো।
সামনের সিটের বাচ্চা ও তার মা, আর পাশের সিটের সহযাত্রীর থেকে বিদায় নিয়ে নেমে পড়লাম। সিকিউরিটি এরিয়া পার হয়ে বিশাল লাউঞ্জ এলাকায় এসেই মনে হল হারিয়ে গেছি। আর সেই-যে ধাক্কাটা, লাগলো এখন। মনে হচ্ছিল কী নির্বোধের মত কাজ করছি। সব ছেড়ে এত দূর যাত্রার তো কোনও মানে হয় না। এরচেয়ে এখান থেকেই একটা ফিরতি ফ্লাইট ধরে ফিরে গেলে কেমন হয়? যদি কানেক্টিং ফ্লাইট মিস করে বসে থাকি তাহলে ইমিগ্রেশন কি এমনিই ধরে দেশে পাঠিয়ে দিবে? ভালই হবে তাহলে। এসব চিন্তা করতে করতেই ফ্লাইট ইনফরমেশন ডিসপ্লের সামনে বসে পড়লাম। তখন মনে হয় বাংলাদেশে প্রায় রাত তিনটা। ফোন দিয়ে তো কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। কথা বললাম ইউকে আর ইউএসএ তে দুই মামার সাথে। কাছের বন্ধুদের সাথে। তুমুল ঝাড়ি আর ঠ্যাং ভেঙে দেওয়ার হুমকি খেয়ে মাথা মোটামুটি ঠাণ্ডা হলে লাউঞ্জটা ঘুরে দেখার চেষ্টা শুরু হল।
সে এক এলাহি কারবার। বিমানবন্দর তো না, যেন কোনও বিশাল শপিং মল। মার্কিন মুলুকের একজন ছোটভাইয়ের জন্য কিছু ধূম্র-শলাকা আর প্রায় তিনগুণ দাম দিয়ে একটা পাওয়ার এ্যাডাপ্টার কিনে শপিং মলে ঘোরার সমাপ্তি টানলাম। গিয়ে বসলাম আমার টার্মিনালের সামনে। অনেকেই দেখলাম পায়ের তলায় লাগেজ নিয়ে ঘুমচ্ছেন। আমার অবশ্য সে সাহস হল না। এক কাপ কফি আর পানি কিনে নিয়ে ল্যাপটপে গুঁতোগুঁতি করতে বসে গেলাম। তবে সব দোকানেই দেখলাম জিনিসপত্রের দাম কাতারের মুদ্রায় নিবে, ইউএস ডলারে নিবে না। মাস শেষে ক্রেডিট কার্ড বিল দেখে বুঝলাম কনভার্সন রেটের বাঁশ দেওয়ার জন্য কী চমৎকার ফন্দি!
পরবর্তী ফ্লাইটের জন্য আবার চেকইন করে লাউঞ্জে গিয়ে বসতেই এক অদ্ভুত ব্যাপার! বিজনেস এবং ফার্স্ট ক্লাসের সব যাত্রীদের স্বভাবতই সবার আগে প্লেনে তোলা হচ্ছে, কিন্তু প্রতিটা যাত্রীর ক্যারি-অন লাগেজ খুলে চেক করে তারপর যেতে হচ্ছে। কিন্তু আমাদের মত গরীব যাত্রীদের এসব চেকিং-এর বালাই নেই। ঘটনা কী হল বোঝা গেল না।
উড়োজাহাজে উঠে বসতেই পরিচয় হল পাশের সিটে বসা ইতালিয়ান দম্পতির সাথে। ছুটি কাটিয়ে দেশে ফিরছেন। বিমান আকাশে উঠতে না উঠতেই আবার বিরিয়ানি হাজির। ডিনার সেরে বহু কসরত করে বুড়ো হয়ে যাওয়া ফোনটাকে চার্জে লাগিয়ে লম্বা ঘুম দিলাম। এই বুড়ো ফোনটা যে এর পরে কত ভোগাবে তা যদি জানতাম! ঘুম ভাংতে দেখলাম বাইরে ঝকঝকে আকাশ। ঘণ্টা-দু’একের মধ্যে হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছে যাব। নাস্তায় দেওয়া স্যান্ডুইচ নাড়াচাড়া করতে করতে ভাবছি বহুদূর চলে এসেছি – ফিরে যাওয়ার চিন্তা করাটা বৃথা।
Leave a Reply