[এটা একটা নিতান্তই ব্যক্তিগত বকর বকর ধরনের লেখা। মার্কিন মুলুকে যাত্রা পথের এবং অবস্থানকালীন টুকিটাকি স্মৃতিচারণ। মুখবন্ধেই এটা স্বীকার করে নিচ্ছি যে এই লেখায় বিলেত গমনের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য খুবই কম থাকবে। গুগলের বোকাবটের কল্যাণে যদি ভুলক্রমে এখানে এসে পড়েন, ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।]
[আগের পর্ব]
বাঙালিকে যতই খ্যাত, আন-কালচার্ড, কাণ্ডজ্ঞানহীন বলে গাল দেওয়া হোক না কেন, বিমান রানওয়েতে ছোটা বন্ধ করা মাত্রই আইল ধরে হুড়োহুড়ি করে দাঁড়িয়ে যাওয়া সব দেশের মানুষেরই অভ্যাস বলে মনে হল। সাদা-কালো-তামাটে-খয়েরি, বিলেতি-বাঙালি-ভারতীয়-আরবি সবাই আইল ধরে দাঁড়িয়ে গেল দরজা খোলার আগেই। প্রতিটা বিমানবন্দরেই একই অবস্থা!
বিমান থেকে নেমে দীর্ঘ সর্পিলাকার পথ পার হয়ে যখন ইমিগ্রেশনের লাইনে পৌঁছলাম, ততক্ষণে সেখানে গরুর হাঁটের মতই ভিড়। আহা সেই সময়, যখন মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে পেছন থেকে ধাক্কা-ধাক্কি করতো, গলা খুসখুস করলে কাশি দিতে লজ্জা পেত না! ব্যাগ থেকে কাগজপত্র বের করে হাতে নিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। মোবাইলের চার্জ প্রায় শেষ। এয়ারপোর্ট থেকে পিক করার জন্য যে ভদ্রলোক এসেছেন তাকে একটা টেক্সট করলাম। অন্যদেরও পৌঁছেছি জানিয়ে ফোন বন্ধ করে রাখলাম চার্জ বাঁচানোর জন্য। পোর্টেবল চার্জার ব্যাগে আছে যদিও, কিন্তু এই বুড়ো ফোনকে একটা বিশেষ ভঙ্গিমায় চার্জারের সাথে চেপে ধরে না রাখলে তো চার্জ হবে না। আর এত কাগজপত্র হাতে নিয়ে সেটা সম্ভব না।
শেষ পর্যন্ত যখন ইমিগ্রেশন অফিসারের ডেস্কে পৌঁছলাম, ততক্ষণে প্রায় ৪৫ মিনিট পেরিয়ে গেছে। এবং তার সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম সরকারী কর্মকর্তা সব দেশেই একই রকম। তারা যা বুঝে সেটাই ঠিক, আইনে যাই থাকুক না কেন! কাস্টমস ফর্ম হাতে পূরণ না করে ডিজিটালি করা কেন এই অজুহাতে আবার ফেরত পাঠাল। কী যন্ত্রণা! কিছুক্ষণ কথা বলে বুঝলাম এই লোক ঘাড় ত্যাড়া। কথা না বাড়িয়ে আরেকটা ফর্ম নিয়ে পূরণ করে আবার লাইনে। তারপর নতুন আরেক ডেস্কে। সে আবার কী কারণে কে জানে, ভেতরের অপেক্ষার এলাকায় পাঠিয়ে কাগজপত্র নিয়ে গায়েব। যাই হোক অন্তত একটু বসার সুযোগ পাওয়া গেল, এই ফাঁকে মোবাইলের চার্জ একটু বাড়ানোর চেষ্টা করা যাক। মিনিট পনের পরে দেখি দূর প্রান্তের তৃতীয় আরেকজন কর্মকর্তা হাত নেড়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। তার ডেস্কে পৌঁছাতেই পাসপোর্ট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “অল সেট”। যদিও পরে আরও অনেক যন্ত্রণা বাকি আছে, তখন তো আর বুঝিনি! হলুদ দাগ পেরিয়ে মার্কিন মুলুকে ঢুকে পড়লাম।
নানান ডেস্কে ঘুরতে ঘুরতে এত সময় পার হয়েছে যে আমার ফ্লাইটের বাকি যাত্রীরা অনেক আগেই চলে গেছে। আমার একমাত্র ব্যাগটা বেল্টের একপাশে কেউ নামিয়ে রেখেছেন। সেটা ঠেলতে ঠেলতে বের হয়ে এসে ফোন চালু করলাম। বের হতেই একটা ম্যাকডোনাল্ডসের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই দেখি আমাকে নিতে আসা ভদ্রলোক খুঁজতে খুঁজতে ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসছেন। চমৎকার লোক ইনি। কাজ থেকে রিটায়ার করেছেন। এখন ভলান্টিয়ারি আর চ্যারিটি দিয়ে সময় কাটান। আমার মত অভাগাদের এয়ারপোর্ট থেকে ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছে দেওয়াও তার মধ্যে একটা।
পার্কিং এর রসিদ নিয়ে বাইরে বের হতেই মেঘলা আকাশ স্বাগত জানালো। আরও প্রায় এক ঘণ্টার পথ। ফোন বন্ধ হয় হয় অবস্থা, এদিকে যেই এপার্টমেন্টে গিয়ে উঠবো তাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না! একটা ভয়েস মেসেজ রেখে টুকটাক কথা বলতে বলতে রওয়ানা হয়ে গেলাম নতুন ঠিকানায়।
গন্তব্যে পৌঁছে যা ভয় পাচ্ছিলাম, তাই। কেউ নেই বাসায়, ফোনেও কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না, নিজের ফোনও চার্জের অভাবে বন্ধ, পুরাই দিশেহারা অবস্থা। আরও একবার মনে হল – “কী দরকার ছিল নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে এত দূরে আসার?” আমার গাইডেরও আমাকে দেখে মনে হয় দয়া হল। যদিও আমাকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছানোই তার দায়িত্ব, উনি আরও কিছুক্ষণ আমার সাথে বসলেন। পাসের একটা বারে গিয়ে বসলাম। ভদ্রলোক একটা বিয়ার নিলেন আর আমি একটা পেপসি। গাট্টি বোঁচকা নিয়ে হাজির হওয়া দেখে বার-টেন্ডারও মনে হয় বুঝল মাত্রই “লঞ্চ থেকে এসে নেমেছি!” পেপসিটা এমনিই দিয়ে বলল “ওয়েলকাম টু আমেরিকা!” তাহলে, মার্কিন মুলুকে এসে আমার প্রথম কেনা জিনিস হল এক মগ বিয়ার! গল্প করতে করতে ভদ্রলোক বলছিলেন – “আমাদের সবাইকে ট্রাম্পকে দিয়ে জাজ করো না, বেশিরভাগ মানুষই তার মত না।” আচ্ছা তবে!
আবার এপার্টমেন্টে ফিরে এসে সিকিউরিটি গেটের ভিতরে ঢুকলাম অন্য একজনকে বলে। গাইড ভদ্রলোক ফিরে গেলেন নিজের কাজে। আরও প্রায় ১৫/২০ মিনিট পরে এপার্টমেন্টের বর্তমান বাসিন্দা যখন এসে পৌঁছল, ততক্ষণে ভাবছি বের হয়ে অন্য কোথাও জায়গা খুঁজবো কিনা…
বাসায় ঢুকেই প্রথমে গোসল। প্রায় ৩৫ ঘণ্টার যাত্রার ধকল, ধুলাবালি, আর দুর্গন্ধ দূর করে মনের জোর ফিরে আসলো। মাথার ধুসর পদার্থও আবার কাজ শুরু করলো মনে হয়। আমাকে এতক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে রাখায় আগের বাসিন্দা একটু লজ্জিত, তার একটু ফায়দা নিলাম। কোনও একটা স্টারবাকসে নামিয়ে দিতে বললাম। তখনই দেখি আমার গাইড ভদ্রলোক আবার আমার খোঁজ নিতে এসেছেন, ঠিকমত বাসায় ঢুকতে পেরেছি কিনা দেখার জন্য। অনেক কৃতজ্ঞতা ভদ্রলোকের প্রতি। স্টারবাকসে পৌঁছে একটা স্যান্ডুইচ আর কফি সামনে নিয়ে, ওয়াইফাই-এ ঢুকে মনে হল আবার সভ্যতায় ফিরে এলাম। যদিও বাসার কাছেই একটা থাকা সত্ত্বেও প্রায় দুই মাইল দূরের স্টারবাকসে সে কেন নিয়ে গেল বুঝলাম না।
স্টারবাকস থেকে উদ্ধার করলেন আমার দুই সপ্তাহ আগেই এসে পৌঁছানো আর এই শহরের আরেক পুরনো বাসিন্দা বাঙালিরা। নতুন মোবাইল নাম্বার একটিভেট হল, ওয়ালমার্ট থেকে একগাদা জিনিসপত্র কেনা হল। এবার মনে হচ্ছে এখানের চ্যালেঞ্জের জন্য রেডি। দেখাই যাক সামনে কী আছে…
Leave a Reply