জীবনে দিন দিন ব্যস্ততা বাড়তে থাকে আর সম্পর্কগুলো ফিকে হয়ে যায়। স্বার্থপরের মত সবকিছুই হয়ে যায় আমিময়। গভীর বন্ধুত্বগুলো শুধুই “কিরে কেমন আছিস” -এ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে অলস সময়ে স্মৃতিগুলো শুধু একটু জ্বালা যন্ত্রণা করে। তারপরে আবারও আমি আমি আমি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টুকু সত্যিই অসাধারণ ছিল। আর তার কারণ অসাধারণ কিছু বন্ধু। সেই কাছের বন্ধুদের একজনকেই আজকের এই লেখাটুকু।
আমরা ক্লাস শুরুর ২-৩ দিন পরে পিচ্চি একটা মেয়ে ক্লাসে এসে হাজির। কোনও একটা উদ্ভট কারণে আমাদের ক্লাসে ছেলে এবং মেয়েরা আলাদা সারিতে বসত প্রথম দিন থেকেই (এর জন্য সম্ভবত রুবীর বোরখা দায়ী)। সে যাই হোক, আলাদা বসলেও কিভাবে কিভাবে যেন ক্লাসের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় সব ইনফরমেশনগুলো পাস হয়ে যেত। মেয়েটা ক্লাসে আসার কয়েক মিনিটের মধ্যেই জানতে পারলাম সে খেলোয়াড় হিসেবে আমাদের ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেছে। আর সে কারণেই ২-৩ দিন দেরি। স্বভাবতই ক্লাসের সবচেয়ে শেষ রোল নাম্বারটা তাকে এসাইন করা হলো – ৬৬। আমার রোল নাম্বার ছিল ৩৩। বেশ মজাই লাগলো। প্রথম দিন ভাবছিলাম মাথার পেছনে ছোট্ট পনিটেইল করা এই পিচ্চি মেয়েটা কি খেলতে পারে! কয়েকদিন পরেই আবিষ্কার করলাম এই মেয়েটা তুখোড় দাবাড়ু। সিম্মি জয়েন করেই কিভাবে যেন কাশফিয়ার সাথে ভিড়ে গেল। সিম্মির নামের উচ্চারণ কিন্তু শিম্মি কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পুরোটা সময় ভুল বানানে আর ভুল উচ্চারণে ওর নাম সিম্মি বলে খেপাতাম।
কিছুদিন পরেই আবিষ্কার করলাম এই মেয়েটা শুধু দাবায় না, লেখাপড়ায়ও তুখোড়। আমাদের সময় যখন হারিকেন দিয়ে খুঁজেও ২-১ জন এ+ পাওয়া যেত না সেই সময় এই মেয়েটা ইংরেজীতে এ+ পেয়েছিল! ফার্স্ট ইয়ার ফাইনালে সিম্মির কল্যানেই কিভাবে যেন মোটামুটি ভাল রেজাল্ট করে ফেললাম।
সিম্মির একটা নিক নেম ছিল আমাদের বন্ধুদের মধ্যে – “লক্ষী মেয়ে”। প্রতিদিনই ক্লাস শেষ হওয়ার সাথে সাথেই যখন আমরা আড্ডাবাজী বা ২৯ খেলতে বসতাম সিম্মি বলতো – “বাসায় যাব”। লক্ষী মেয়ে নামের কারণ এটাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেন্ড ইয়ারে উঠার পরে সবার মধ্যেই একটা প্রেম প্রেম ভাব আসে। তখন প্রেম করাটা মোটামুটি রুটিন ব্যপার। দেখা গেল আমাদের বন্ধুদের গ্রুপের সবাই প্রেম করে ফেলেছে শুধু আমি, সিম্মি আর অতুল বাকি। অতুল বেচারা একটু মুখচোরা হওয়ায় বাকিরা আমাকে আর সিম্মিকে বেশ খেপানোর চেষ্টা করতো। আর “লক্ষী মেয়ে” সিম্মি যে কোনও উপায়ে এই ক্ষেপানো থেকে বাঁচার উপায় খুঁজতো। একদিন দুপুরে মেডিকেল থেকে লাঞ্চ করে রিকশায় ফিরছি এমন সময় ঝুম বৃষ্টি। রিকশায় হুড তুলে বসলে সবাই আবার ক্ষেপাবে এই যুক্তিতে দুইজন রিকশায় হুড খুলে বৃষ্টি বিলাস করতে করতে কাক ভেজা হয়ে ক্লাসে ফিরলাম! একমাত্র লেখাপড়া ছাড়া আর সব বিষয়েই সিম্মির যুক্তিগুলো এরকম অদ্ভুতই ছিল। এমন অদ্ভুত মেয়েটা কিভাবে যে এত ভাল দাবা খেলে সেটা আমার মাথায় ঢুকে না।
মাঝে মাঝেই ক্লাস শেষ হওয়ার সাথে সাথে সিম্মি দৌড় দিত দাবা ফেডারেশনে খেলার জন্য। কোনও কোনও দিন আমি যেতাম খেলা দেখতে। দুঃখের বিষয় যেদিনই আমি যেতাম সেদিনই ও হেরে যেত! আমি গেলেই সম্ভবত “কুফা” লেগে যেত। এই কারণে কিছুদিন পর থেকে সিম্মির খেলা থাকলে আমি দাবা ফেডারেশনের আশে পাশে যাওয়াই বন্ধ করে দিলাম। লক্ষী মেয়েটা বেশ সেলিব্রিটি খেলোয়াড় হয়ে গেছে। আর আমিময় আমার বেশ গর্ব লাগছে মেয়েটাকে আমার বন্ধু বলতে পেরে। অনেক শুভকামনা তোর জন্য।
Leave a Reply