[এটা একটা নিতান্তই ব্যক্তিগত বকর বকর ধরনের লেখা। মার্কিন মুলুকে যাত্রা পথের এবং অবস্থানকালীন টুকিটাকি স্মৃতিচারণ। মুখবন্ধেই এটা স্বীকার করে নিচ্ছি যে এই লেখায় বিলেত গমনের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য খুবই কম থাকবে। গুগলের বোকাবটের কল্যাণে যদি ভুলক্রমে এখানে এসে পড়েন, ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।]
দুই-তিন দিনের তাপ-দাহ শেষে হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টির এক দুপুরে ঢাকা থেকে মার্কিন মুলুকের উদ্দেশ্যে যখন যাত্রা শুরু হল, তখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি যে সব ছেড়ে কত দূরের পথে রওয়ানা হচ্ছি। তখন মাথায় একমাত্র চিন্তা, সামনে ৩০ ঘণ্টার লম্বা সফর! ধাক্কাটা প্রথম লাগবে মোটামুটি ৮-৯ ঘণ্টা পরে। সে ব্যাপারে পরে আসছি।
মার্কিন মুলুকে যাত্রার প্রস্তুতি মূলত শুরু হয়েছিল এক মাস আগে থেকে। দূতাবাসের হাসিখুশি কর্মকর্তা যখন বলল আপনাকে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে, এক সপ্তাহ পরেই পাসপোর্ট হাতে পাবেন – তার পর থেকে। তার আগের যা কিছু সবই ঝুলন্ত। মোটামুটি প্রস্তুতি ছিল যে কর্মকর্তা আমাকে বিমুখ করবেন, আর আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচবো। কে চায় তার চেনা জগত থেকে বের হয়ে অচেনা রাস্তায় পা রাখতে?
দূতাবাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করেন বটে। সেই ব্যাপারে দুই কথা বলা যেতে পারে। এই অভিজ্ঞতাটা আমার কাছে খুবই অসম্মানজনক মনে হয়। মেহমান হয়ে এসে তারা রাজার হালে বসে আছেন, আর নিজ দেশে আমরা যেন মিসকিনের মত লাইন ধরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। নিদেনপক্ষে একটা বসার জায়গা করা যেত। মনে মনে স্বপ্ন দেখি, একদিন আমাদেরও হবে। “আজ গরীব বলে” পাত্তা দিচ্ছ না! ট্রাম্প মামুর মত আর দু’একটা লোক যদি সামনে মার্কিন মুলুক শাসনের ভার পায় আর আমারা যদি রাস্তা না হারাই, দু’এক দশকের মধ্যেই দাবার ছক উলটে যাবে।
সে যাক – ভেতরে ঢুকে তো মনে হল দুর্গে প্রবেশ করলাম। ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন দুর্গের মত করে তাদের ব্যবসার কুঠি নির্মাণ করতো, তখন সম্ভবত বাঙালি অভাজনের সেই কুঠিতে প্রবেশ করে এমনই মনে হতো। প্রথমে সাক্ষাৎকারের তালিকায় নাম মিলিয়ে পাসপোর্টে বারকোড লাগিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। এরপর আবার অপেক্ষা। এই অপেক্ষার সময় সম্ভবত সবারই তৃষ্ণা পেয়ে গেল। এরপরে আঙুলের ছাপ দিয়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণ হতে হতে প্রায় দেড় ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। সর্বশেষ যখন কর্মকর্তা আমার পুরনো হাতে লেখা পাসপোর্ট দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন “আপনার হাতে লেখা পাসপোর্টে নাম ভিন্ন কেন?” – আমার দেশের পাসপোর্ট বিভাগের বড়কর্তাদের মুন্ডুপাত করতে করতে বত্রিশ পাটি (আসলেই কিন্তু বত্রিশটা দাঁত) বের করে বললাম – আর বলবেন না, সেই সায়েস্তা খাঁ’র আমলের পাসপোর্ট। তখন হাতে লেখা ফর্মে “ডাক নাম” লেখার একটা জায়গা থাকতো। কাঁচের অপর প্রান্তে সেই কর্মকর্তা চোখ বড় বড় করে বললেন “ডাক নাম! কও কী?” অতঃপর নীল একখানা ফর্দ ধরিয়ে বললেন এক সপ্তাহ পরেই পাসপোর্ট হাতে পেয়ে যাব। শুনেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। কোনক্রমে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বের হলাম সেই দুর্গ থেকে।
দূতাবাস কর্মকর্তা নিরাশ করবেন – এই আশায় তো বিমানের টিকেট করিনি, বাসা ভাড়াও না। এখন আমার হবে কী? দুর্ভাগ্যক্রমে তখন আবার ঈদের সময়। টিকেটের দাম আকাশচুম্বী। বাড়ি ভাড়ার জন্য যাদেরই বার্তা পাঠাই তার দশ ভাগ উত্তর দেয়। তাদের মধ্যে প্রায় সবাই আবার বলে আগে টাকা দেও, তারপর কথা। শেষমেশ যদিও টিকেট ও বাড়ি ভাড়া হল, বেশ কিছু টাকা গচ্চা দিয়ে আরকি। তার উপরে বিমান কোম্পানির শর্ত দেওয়া আছে একটার বেশি বোঁচকা নিয়ে রওয়ানা দিলেই জরিমানা হবে! কী জ্বালা!
বড়ই অদ্ভুত ধরণের বিমান টিকেট হল। টিকেটের গায়ে লেখা “ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ”। কিন্তু উঠতে হবে “কাতার এয়ারওয়েজ” এর বিমানে। তারা আবার লন্ডন এনে ছেড়ে দিবে – তখন গিয়ে উঠতে হবে “আমেরিকান এয়ারলাইন” এর বিমানে। এর আগে এত লম্বা বিমান যাত্রার অভিজ্ঞতা না থাকায় নানা ধরনের দুঃশ্চিন্তা মাথায় ঘুরছিল। সে যাক, শেষ পর্যন্ত আগস্ট মাসের বৃষ্টিভেজা এক বিকেল যাত্রা করলাম বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে।
ঢাকার বিমানবন্দরে প্রথমেই যেটা চোখে পড়বে তা হচ্ছে বিভিন্ন আলাদা আলাদা সংস্থার মধ্যে বিশৃঙ্খলা। আমরা আসলে এখনো নতুন নতুন শিখছি তো “উচ্চ নিরাপত্তা এলাকা” কিভাবে চালাতে হয়। আশা করি বছর খানেকের মধ্যে সবকিছু নিয়মের মধ্যে চলে আসবে। তার আগ পর্যন্ত এই বিরক্তিকর বিশৃঙ্খলা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। সে যাক ভেতরে ঢুকে ব্যাগ বোঁচকায় স্টিকার লাগিয়ে নিতে বেশি সময় লাগেনি। তবে সবার থেকে বিদায় নেওয়াটাই কষ্টকর। এর আগে যখনই কাউকে বিমানবন্দরে বিদায় দিতে গিয়েছি, অন্যদের কান্না দেখে অবাক লেগেছে। কিন্তু নিজে বিদায় নিতে গিয়েই মনে হচ্ছিল, চোখের জল আটকে রাখাটাই সবচেয়ে কষ্ট। বিশেষ করে যখন আশে পাশের সবার চোখ ছলছল, তখন নিজেকে শক্ত রাখাটাই কষ্ট। কান্না আটকে ঢুকে পড়লাম ইমিগ্রেশনের লাইনে। বিপত্তির শুরু এখানেই।
লাইনে দাঁড়িয়েই বুঝতে পারলাম কেন দেশ ত্যাগের সময় সবাই বিমান ছাড়ার ২/৩ ঘণ্টা আগেই ইমিগ্রেশনে ঢুকে পড়ে। কোথায় যে বিপত্তি বাঁধবে তার কোনও ঠিক নেই। সামনে মাত্র ৩ জন আছে দেখে সবচেয়ে ছোট লাইনের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আর নিয়তি’র নিয়ম – ছোট লাইনই সবচেয়ে আস্তে চলে। প্রথম দু’জনের ইমিগ্রেশন যদিও ১০/১৫ মিনিটে শেষ হল, তৃতীয় জন থেকেই সব ভজঘট। তাঁর পাসপোর্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র নিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে ইমিগ্রেশন শেষ করতে মোটামুটি ৪৫ মিনিট লাগলো। ততক্ষণে অন্য সব লাইনও মোটামুটি লম্বা হয়ে গেছে। উড়োজাহাজের লোকজনও যাত্রীদের খোঁজে ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে। তৃতীয় জনের বিপত্তি মিটে যাবার সাথে সাথেই পেছন থেকে এক যাত্রী এসে অনুরোধ করলেন – তার বিমান পাঁচ মিনিটের মধ্যে ছেড়ে যাবে, তাকে যেন একটু আগে যাওয়ার সুযোগ দিই। আর অনুরোধে ঢেঁকী গেলার পুরনো অভ্যাসমতে “হ্যাঁ” বললাম। শেষমেশ ইমিগ্রেশন পেরিয়ে অপর প্রান্তে যেতে যেতে দেখি আমার উড়োজাহাজের বোর্ডিং প্রায় শেষের পথে। টুকিটাকি কেনাকাটা বা ঘুরাঘুরি বাদ দিয়ে দৌঁড় লাগাতে হল বোর্ডিং লাউঞ্জের উদ্দেশ্যে। এখানে একটা কথা না বললেই নয় – আমাদের ইমিগ্রেশন অফিসাররা খুব হাসিখুশি, সহনশীল – তা নয়, কিন্তু আমরাও তেমন ভদ্রলোক নই। যেখানে একটা সামান্য হাসি, একটা “সরি” বা ধন্যবাদেই সব মিটে যেতে পারে, সেখানে আমরা গায়ের জোর দেখিয়ে ঝগড়া করতে খুবই পছন্দ করি। দেড় ঘণ্টার ইমিগ্রেশন লাইনে এমন অন্তত তিনটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করে ভাবছিলাম, সারাদিন এমন ঝগড়াটে লোকজন সামলাতে হলে যে কোনও দেশের ইমিগ্রেশন অফিসারেরই মেজাজ চড়ে থাকা স্বাভাবিক।
অবশেষে যখন বিমানে চড়লাম – ততক্ষণে বিমান ছেড়ে যাওয়ার সময় ১০ মিনিট পেরিয়ে গেছে। একটা কথা বলতেই হবে। কাতার এয়ারওয়েজ এর বিমান ও ভেতরের সেবা চমৎকার। সবচেয়ে কমদামী সিটের যাত্রীর জন্যও কুশন, কম্বল, হেড ফোন ইত্যাদির প্যাকেট। সিটগুলোও বেশ আরামদায়ক। আরামদায়ক সিটে বসে এন্টারটেইনমেন্ট সিস্টেম নাড়াচাড়া আর সবার থেকে ফোনে বিদায় নিতে নিতে বিমানের নড়াচড়া শুরু হল। প্রায় এক ঘণ্টা দেরী করে রওয়ানা হওয়ায় একদিক থেকে আমার জন্য ভালই হল – কাতারে গিয়ে পাঁচ ঘণ্টার যাত্রাবিরতি অন্তত একটু কমলো।
রানওয়ের আলো গুলো প্রথমে ধীরে ধীরে তারপর তীব্র গতিতে পেছনে যাত্রা করলো – তারপরই অন্ধকার। মেঘলা আকাশের ফাঁক দিয়ে শেষবার দেখে নিলাম প্রিয় শহরের আলোর ঝলকানি। মেঘের সীমা পেরিয়ে আরও উপরে উঠে পড়তেই নিঃসীম অন্ধকারে হারিয়ে গেলাম যেন। ফিরে এলাম আলো ঝলমলে বিমানের ভেতরে। বিমানবালা রাতের খাবারের মেনু আর বাদাম চাই কিনা জানতে এসেছেন। আমার প্রিয় শহর, জাদুর শহরকে পেছনে ফেলে যাত্রা শুরু হল অজানার দিকে।
Leave a Reply